আমাদের দেশে প্রচলিত একটি ধারণা আছে যে স্ট্রোক হৃৎপিণ্ডের একটি রোগ। বাস্তবে এটি মোটেই সত্য নয়। স্ট্রোক মস্তিষ্কের রোগ। মস্তিষ্কের রক্তবাহী নালির দুর্ঘটনাকেই স্ট্রোক বলা যায়। এই দুর্ঘটনায় রক্তনালি বন্ধও হতে পারে, আবার ফেটেও যেতে পারে। এ কারণে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। স্ট্রোক সম্পূর্ণই মস্তিষ্কের রক্তনালির জটিলতাজনিত রোগ।

স্ট্রোকে আক্রান্তের হার দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রে সচেতনতার অভাবেই এই রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের দেশে এখন ১৫ থেকে ২০ লাখ স্ট্রোকের রোগী রয়েছে। প্রতি হাজারে গড়ে ৩ থেকে ৫ জন স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছে। সাধারণত পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মধ্যে স্ট্রোকে আক্রান্তের হার বেশি লক্ষ করা গেলেও যে কোনো বয়সেই তা হতে পারে। ৫০ বছর বয়সের পর প্রতি ১০ বছরে স্ট্রোকের ঝুঁকি দ্ব্বিগুণ হয়। আক্রান্তদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যাই বেশি। নারীদের মধ্যে স্ট্রোকে আক্রান্তের হার কিছুটা কম।

ছবি সংগৃহীত

যেসব কারণ স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে—
>>অনিয়ন্ত্রিত উচ্চরক্তচাপ স্ট্রোকের সবচেয়ে বড় কারণ। রক্তচাপের রোগী যারা নিয়মিত ওষুধ ব্যবহার করে না বা কয়েক দিন খেয়ে প্রেশার কমে গেলে ওষুধ বন্ধ করে দেয় বা মনে করে উচ্চরক্তচাপে তার শারীরিক কোনো সমস্যা হচ্ছে না, তাই রক্তচাপের ওষুধ সেবন করে না।

>>ধূমপান, তামাকপাতা, গুল, জর্দা, মাত্রাতিরিক্ত মাদক সেবন।

>>অতিরিক্ত টেনশন, হূদেরাগ, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, রক্তে বেশি মাত্রায় চর্বি বা অতিমাত্রায় কোলেস্টেরলের উপস্থিতি।

>>অনিয়ন্ত্রিত অলস জীবন যাপন করা, বেশি বেশি চর্বিজাতীয় খাবার খাওয়া, স্থূলতা বা অতিরিক্ত মোটা হওয়া, অতিরিক্ত মাত্রায় কোমল পানীয় গ্রহণ এবং অধিক পরিমাণে লবণ খাওয়া।

>>কিছু কিছু ওষুধ যা রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষমতা কমিয়ে দেয় যেমন অ্যাসপিরিন, ক্লপিডগ্রেল প্রভৃতি ব্যবহারে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হতে পারে।

>>ঘুমের সময় নাক ডাকা, ঘুমের সময় শ্বাসকষ্টজনিত উপসর্গ।

>>যে কোনো ধরনের প্রদাহ অথবা ইনফেকশন এবং জন্মগতভাবে ব্রেনে কিংবা মস্তিষ্কে সরু রক্তনালি থাকা।

>>অনেক সময় বংশানুক্রমে বা পূর্বের স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক ও দূরবর্তী রক্তনালি বন্ধ হওয়ার কারণেও স্ট্রোক হতে পারে।

>>যারা আগে থেকে বিভিন্ন রকমের হৃদরোগে ভোগে যেমন: ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ, হার্টের ভাল্বে সমস্যা, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, ইতিপূর্বে মিনি স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়া ইত্যাদি।

স্ট্রোক হলে কী চিকিৎসা দিতে হবে :

আক্রান্ত রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। স্ট্রোক হয়ে গেলে চিকিৎসা অত্যন্ত জটিল।

>>রোগীর উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয়। যদি খেতে না পারে, তবে নাকে নল দিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। প্রস্রাব ও পায়খানা যাতে নিয়মিত হয়, সেই ব্যবস্থা নিতে হবে, প্রয়োজনে প্রস্রাবের রাস্তায় ক্যাথেটার দিতে হবে। চোখ, মুখ ও ত্বকের যত্ন নিতে হবে। বেডসোর প্রতিরোধ করার জন্য নিয়মিত পাশ ফেরাতে হবে।

>>উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পাশাপাশি অনেক স্ট্রোক রোগীর হার্টের রোগ থাকে। এসব ক্ষেত্রে কারডিওলজিস্টের পরামর্শের প্রয়োজন হয়।

>>অন্যান্য চিকিৎসা স্ট্রোকের ধরন অনুযায়ী করা হয়। যেমন ইশকেমিক স্ট্রোকের বেলায় এসপিরিন, ক্লোপিডগ্রিলজাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়। রক্তক্ষরণের কারণে স্ট্রোক হলে অপারেশনের প্রয়োজন হতে পারে।সব হাসপাতালেই থাকা উচিত একটি স্ট্রোক কেয়ার ইউনিট; যেখানে ডাক্তার, নার্স, থেরাপিস্ট ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞ সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে স্ট্রোক রোগীর চিকিৎসা দেবেন।

>>একজন স্ট্রোক রোগীর প্রয়োজন হয় নিউরোলজিস্ট ও নিউরোসার্জনের। অনেক স্ট্রোক রোগীর অপারেশন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

>>অনেক রোগীর শ্বাসকষ্ট, বেডসোর প্রভৃতি সমস্যা দেখা দেয়। সুতরাং রেসপিরেটরি মেডিসিন স্পেশালিস্ট, প্লাস্টিক সার্জনসহ সবার সহযোগিতার প্রয়োজন হতে পারে।

>>রোগীর অঙ্গ সঞ্চালন করে জড়তা কাটিয়ে তুলতে রিহ্যাবিলিটেশন বা পুনর্বাসনের জন্য ফিজিওথেরাপিস্ট প্রয়োজন হয়।

>>রোগী কথা বলতে না পারলে প্রয়োজন স্পিচ থেরাপিস্টের।

>>স্ট্রোক কেয়ার ইউনিট, সমন্বিত স্ট্রোক কেয়ার টিমের ব্যবস্থাপনায় চিকিত্সায় আসবে সুফল, রোগী ও রোগীর স্বজন হবে চিন্তামুক্ত, রোগী লাভ করবে আরোগ্য।

যেভাবে প্রতিরোধ সম্ভব:
>>স্ট্রোক প্রতিরোধযোগ্য রোগ,চিকিৎসা চেয়ে এই রোগ প্রতিরোধই উত্তম। ব্রেনের কোষগুলো একবার নষ্ট হলে পুনরায় পুরোপুরিভাবে কার্যকর হয় না অথবা জন্মায় না। এর জন্য সুনির্দিষ্ট ও জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। গ্রামাঞ্চলে কিংবা শহরের যে কোনো হাসপাতালে এ রোগের চিকিৎসা সম্ভব। নিয়মিত ওষুধ সেবনের মাধ্যমে উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে এবং রক্তের চর্বি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

>>ধূমপান, মদ্যপান, মাদক দ্রব্য, তামাকপাতা ও জর্দা খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। হৃৎপিণ্ডের রোগের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে হবে।

>>চর্বি ও শর্করাযুক্ত খাবার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, শারীরিক ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকলে ওজন কমানো, খাদ্যে পশুর চর্বি ও অধিক পরিমাণ লবণ গ্রহণ থেকে বিরত থাকা। ফাস্টফুড, বাদাম, সন্দেশ-রসগোল্লা, দুধ-ঘি-পোলাও-বিরিয়ানি, পাঙাশ-চিংড়ি-কাঁকড়া, গরু বা খাসির মাংস, নারকেল বা নারকেলযুক্ত খাবার ইত্যাদি কম খাওয়া উচিত।

শাকসবজি, অল্প ভাত, পাঙাশ-চিংড়ি-কাঁকড়া বাদে যে কোনো মাছ, বাচ্চা মুরগি ও ডিম খেলে কোনো ক্ষতি হয় না। নিয়মিত ব্যায়াম, সকাল-বিকাল হাঁটাচলা করতে হবে এবং অলস জীবনযাপন পরিহার করতে হবে। দুশ্চিন্তা বা টেনশনমুক্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে। নিয়মিত ধর্মচর্চা এ ব্যাপারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

স্ট্রোক অবশ্যই একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। একবার আক্রান্ত হয়ে গেলে চিকিৎসা অত্যন্ত জটিল, ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য। আক্রান্ত রোগী নিজে মানসিক ও শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, পরিবারের জন্য অনেক সময় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তাই প্রতিরোধ করাই সর্বোত্তম।